বরাবর,
ফতোয়া বিভাগ, আল জামিয়াতুল আরাবিয়া দারুল হিদায়া পোরশা,নওগাঁ।
বিষয়: রাগের মাথায় তিন তালাক প্রদান করা প্রসঙ্গে।
প্রশ্ন: মুহতারাম, আমার বিয়ে হয় ২০১৯ সনে পারিবারিক ভাবেই। আমি আল্লাহর রহমতে দ্বীন চর্চা শুরু করি। ২০২১ এর শেষের দিকে সেই বিয়ে করে নিজের চরিত্র হিফাযতের জন্য ব্যস্ত ছিলাম এবং অবশেষে বিয়ে হয়, তবে বিয়ের ক্ষেত্রে আমার তাড়াহুড়ো ছিলো! মেয়ের ব্যাপারে তেমন কোন যাচাই-বাছাই করা হয়নি, আর এটাই ছিল আমার প্রথম ভুল, মেয়ে দ্বীনদার ছিলনা, আলিয়া মাদ্রাসায় পড়তো। আর আমিও বেশ জোশে ছিলাম তাই বিয়েটা করে ফেলি। মেয়ের নিরবতা, চুপচাপ স্বভাব দেখে দ্বীনদারিতা ভেবে মস্তবড় ভুল করেছিলাম। বিয়ের পর থেকে আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামী হিসেবে আমার মৌলিক হকগুলোও পাইনি, আমি সবরের পর সবর করতে থাকি এবং স্ত্রী আমার দিন দিন মানসিক চাপ বাড়াতে থাকে, অবহেলা, অবজ্ঞা আর অ-আন্তরিকতা বাড়তে থাকে। তার বাপের বাড়ী যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে, সেটা যে কোন ইস্যুত তুলে আমার সাথে ঝগড়া করে চলে যায়, আর যাওয়ার পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখতো, আমি কলের পর কল করলেও কোন জবাব পেতাম না, এভাবে তিন মাস গেলে প্রথম তার বাবাকে বিষয়গুলো অবহিত করি। মাঝখানে বহু কথা আমি বাদ দিয়েছি কারণ তা অপ্রয়োজনীয় মনে হলো তাই। আমার স্ত্রী আমার বাচ্চা নিতে চাইনি, আমিই এক প্রকার জোর করে নিই। বিয়ের এক বছর বা আরেকটু বেশি সময় পর আমি ব্রেইন স্ট্রোক করি, কক্সবাজার মেডিক্যালে থেকে আমাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে রেফার করা হয় এবং এই অসুস্থতা ঘটে গত রমাযানে, আমার স্ত্রী আমার প্রতি কোন খেয়ালই রাখতো না, মানসিক চাপ নিতে না পেরে আমার স্ট্রোক হয়! পরে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে জানা গেল আমার শারিরীক কোন সমস্যা নাই মাথা ব্যথা আর অতিরিক্ত রাগের কারণে ব্রেইন স্ট্রোক (স্পট সেন্টার থেকে সরে গিয়েছিল) করেছিল। পরে আমাকে মেডিক্যাল থেকে একজন মানসিক ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হলো। আমিও আমার শহরে এসে কক্সবাজার সদরে একজন সাইক্রিয়াট্রিস্ট (মনোরোগের ডাক্টার) এর সাথে যোগাযোগ করি। ডাক্টার কফিল উদ্দীন স্যার! উনি আমার যাবতীয় সমস্যা ও জীবন বৃত্তান্ত শোনার পর আমাকে দীর্ঘ ৩ মাস ট্রিটম্যান্ট করে লাগাতার এবং এরপরে প্রতি মাসে চেকাপের তাগিদ দেন আমিও তা মেনে চলি এবং আমার স্ত্রী সহ একবার ডাঃ সাহেব চেম্বারে ডাকলেন, আর আমরাও গেলাম এবং তিনি (ডাক্টার) আমার স্ত্রীকে আমার যাবতীয় বিষয় বুঝিয়ে বললেন এবং বললেন, আমার যেন টেনশন আর রাগ না উঠে কোন বিষয়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে, সত্যি বলতে এগুলো আমার স্ত্রীর কানের বাহিরে ছিল, আমার প্রতি তার কোন খেয়ালই ছিল না, আমার প্রতি তার কোন শ্রদ্ধাবোধ দূরে থাকত আমাকে মানুষও মনে করে না। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। স্ত্রীর বিষয়টা প্রসঙ্গে ক্রমে আনতে হচ্ছে। তার পর থেকে আমি মাঝেমধ্যে কোন বিষয়ে টেনশন হলে এবং ঐ সময়ে কোন বিষয় নিয়ে রাগারাগি করলে আমি একটা পর্যায়ে এসে আমার রাগের কারণে জ্ঞানহীন, বেহুশ হয়ে যেতাম, কি বলছি আর কি করছি তাও নিজের অজান্তে। এভাবেই চলতে থাকে আমার জীবন। আমার একটা কন্যা সন্তান আছে, এদিকে আমার মা আর স্ত্রীর মধ্যে বাড়তে থাকে মনোমালিন্যতা, আমার বৃদ্ধ মা আর নাবালক ছোট ভাই আছে পরিবারে, আমার একটা বোন আছে সে তার শশুর বাড়িতেই থাকে। আমাদের ছোট্ট পরিবারে আমার মা ছিল খুবই অবহেলিত, আমি তো কাজের কারণে বাহিরে যেতাম এদিকে আমার মা ঘরের যাবতীয় কাজ করতো, আর আমার টেনশন হবে বলে এ কথা ভেবে আমার সব সহ্য করতো, কোন কারণে বিরক্ত হয়ে আমার স্ত্রীকে কিছু বললেই সে তার ব্যাগ গুছিয়ে তার বাবাকে ফোন করে ডেকে বাপের বাড়ী চলে যেত, আর আমি গিয়ে বার বার বুঝিয়ে সুযিয়ে নিয়ে আসতাম, আমার গায়রত ভুলে গিয়ে স্ত্রীর ইচ্ছা আর খায়েশের দাস বনে গেলাম। তবে আমি তার সব হক আদায় করতাম এবং দ্বীনের বিষয়টা মাথায় রেখে নমনীয়তা দেখাতাম,শাসন বলতে চড় দিয়েছিলাম কয়েকবার তাতেই অনেক বড় কিছু ঘটিয়ে ফেলেছিলো সে এবং সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে সে নতুন ইস্যু তুলে বাপের বাড়ী চলে যায়, অবশ্য আমি তাকে সেবার অতিরিক্ত রাগের কারণে কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে বসি এবং আমার রাগের মাত্রা ছাড়িয়ে আমি আমার নিজের উপর চড়াও হয়ে হাত দেওয়ালে মারি এবং এরপর মাথায় পেইন উঠলে আমি শুয়ে যায় বিছানায়,(এই বিষয়টা আমার মা আমাকে বলেছে পরে) ঠিক এই সুযোগেই আমার স্ত্রী ঘর থেকে বের হয়ে আমার এক বন্ধুর বাসায় যায় এবং তার বাবাকে ডেকে সে চলে যায়, সেদিন ছিল ১৭/০২/২০২৪ তারিখ। তারপর থেকে আমি নিয়মিত আমার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে সে বা তারা আমাকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলে আর যোগাযোগ বন্ধ করে দেই এবং আমি প্রায় ১ মাস পর তার সাথে কথা বলতে সক্ষম হয়, আমার রাগ উঠলে আমার একটা বাজে স্বভাব প্রকাশ পায় , সেটা হলো আমি অতীতে সবর করা বিষয়গুলোও একসাথে সব বলে দিই এবং আমি বলতে চাইনা এসব, কখনোই চাই না পুরোনো বিষয় তুলতে কিন্তু আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা, ডাক্টারের সাথে মাঝখানে যোগাযোগ বন্ধ আছে, আমিও আর্থিক সংকটে পড়ে গেছি, এখন সব মিলিয়ে আমি খুব টেনশনে আছি, এর মধ্যে আমার স্ত্রী আমার বিরুদ্ধে থানায় যত্তসব মিথ্যা অভিযোগ করে, বিচার আচার হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় আমার স্ত্রী আমার সংসার করবেনা, আমাকে ডিভোর্স দিবে এবং এর পেছনে আমার স্ত্রীর সৎ মা ইন্ধন দিয়েছে। আমার নিজরো শাশুড়ী মারা গিয়েছে আরো ১০/১২ বছর আগে। যাহোক আমি এইবার ঈদে বাচ্চা আর বউকে দেখতে শশুর বাড়ীতে গেলে আমার স্ত্রী আমাকে খুবই বাজে আচরণ দেখায়, যাহোক সেটা না বলা ভালই। এখন তিন মাস হতে চললো সে বাপের বাড়ীতে আছে, আমার সাথে যোগাযোগ করেনা, আমি করলেও পাত্তা দেইনা তেমন একটা, বরং তার মা বোনরা খুব বাজে ভাষায় আমাকে কটুবাক্যে তাচ্ছিল্য করে আর উত্তেজিত করে যেন আমি তালাক বা ডিভোর্স দিয়ে দিই, কিন্তু আমার স্ত্রীও দেখলাম আবার আমার সংসার করতে চাই, তবে আমি ডিভোর্স দিলে সে আপত্তি করবে না, বিষয়টা আমি বুঝতে পারি যে সে ডিভোর্স দিলে কাবিনের বিষয়টা জঠিল হবে তাই, যাহোক সেটা তার হক। অল্প টাকা। আমি তাকে নিয়ে আসতে চাইলে সে শর্ত দেয় যে তাকে নিয়ে আলাদা থাকতে হবে, অথচ আমার মাকে দেখার কেউ নেই, আমার দ্বিতীয় পিতাও তেমন রিগুলার না।(আমার প্রথম পিতা মারা যান ২০১০ সনে)। এরপরে আমরা পারিবারিক ভাবে এলাকার মুরব্বিদের দিয়ে তাদের সাথে, মানে আমার স্ত্রীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলে তারা কোন সমাধানে আসতে আগ্রহ দেখান নাই। সর্বসাকুল্যে এখন গত কাল আমি আমার শশুর বাড়িতে যায় এবং বাহিরের মহিলাদের দিয়ে আমাকে যথেষ্ট বাজে কথা শুনাই, আমি বিরক্ত হয়ে চলে আসি। পরে কল দিয়ে তার সাথে রাগারাগি করি এবং রাগারাগি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে আমার মাথা ব্যথা শুরো হয়, পরে কান থেকে মোবাইল সরিয়ে দেখলাম যে আমার আরো ২০ মিনিট আগে ফোন কেটে দিয়েছে, অথচ আমি অযথায় নিজে চিল্লাচিল্লি করলাম। পরে আমি নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি, মাথায় অতিরিক্ত পেইন আর রাগে স্লিপিং ফিল খেয়ে শুয়ে থাকি। আমি “বায়পোলার মুড ডিজঅর্ডার” নামক মেন্টাল ডিজিজে আক্রান্ত যার প্রধান লক্ষ্যণগুলোর একটা হল: রাগ উঠলে স্বাভাবিক হুশ হারানো। পরে আজকে ফজরের পর আমার স্ত্রীর সাথে আবার প্রতিদিনের ন্যায় যোগাযোগ করা শুরু করলাম, আর যেটা শুনালো সেটা হলো, আমি নাকি তাকে গতকাল ঝগড়া করে ১,২,৩ করে তিনটি তালাক দিয়ে ফেলেছি, এখন আমি তো সেটা বলিনি, তারা বললো প্রমাণ আছে, পরে আমাকে ফোন রেকর্ড শুনালো। আমি খুব ভেঙ্গে পড়েছি প্রিয় মুহতারাম শায়েখ। আমি না পারছি আমার এহেন কাজ মেনে নিতে, আর না পারছি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে, কিন্তু যা বলেছি তা আমার অগোচরে, আমার রাগ তো আর মাথার পেইন হলে আমার হুশ থাকেনা কিছুতেই। এখন তারা আমাকে রেকর্ডিং শুনালে আমি নিজেও নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিনা, মাসআলা যতটুকু জানি তালাক যে অবস্থায় দেওয়া হোক পতিত হয়ে যায়, এখন আমার এই তালাক কি পতিত হবে কিনা? সে বিষয়ে সমাধান চাচ্ছিলাম এবং আমি আমার স্ত্রীর এলাকার মুরব্বিদের সাথেও বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছি আজকে তারা বললো লিখিত ফতোয়া আনতে হবে যে, তালাক পতিত হয়েছে কি হয়নি তা। আমার স্ত্রী আমার রাগের বিষয়টা এবং মানসিক ব্যাপারটা জানে, আমার আম্মাও জানে। আপনারা চাইলে তাদের সাথেও এই বিষয়ে জানতে পারেন দরকার হলে! এমন কি ডাক্টারের সাথেও। আমি যাবতীয় চিকিৎসা ফাইলের ছবিও দিতে পারবো দরকার হলে। আমি শুধু এই টা জানতে চাচ্ছিলাম যে শায়েখ, তালাক কি পতিত হবে? আমাকে তারা রেকর্ড যেটা শুনিয়েছে সেটাতে শুনলাম যে আমি আমার শাশুড়ীকেও তালাক শব্দ বলেছি, অথচ আমি আমার ব্যাপারে হলফ করে বলতে পারি যে, আমি এমন বাজে আচরণ করবো না, কিন্তু রেকর্ড আমারই। এখন যদি মুহতারাম শায়েখ দয়া করে তালাক পতিত হওয়া না হওয়ার বিষয়টা জানাতেন ইনশা আল্লাহ খুবই উপকৃত হতাম এবং সংসারটা ভাঙ্গুক তাও চাইনা ইনশা আল্লাহ।
নিবেদক
মুহাঃ আব্দুল্লাহ জুয়েল।
بسم الله الرحمن الرحيم،حامدا و مصليا و مسلما-
সমাধান: প্রশ্নোক্ত বিবরণ যদি বাস্তবেই সত্য হয়ে থাকে এবং রাগ উঠার কারণে এক্ষেত্রে যদি বাস্তবেই স্বাভাবিক হুশ হারিয়ে ফেলে থাকেন এবং আপনি তালাকের কথা কি বলেছেন নিজেও জানেন না, তাহলে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী আপনার স্ত্রীর উপর কোন প্রকার তালাক কার্যকার হয়নি। আপনার স্ত্রী পূর্বের ন্যায় স্ত্রী হিসেবে বহাল আছে। কারণ অতি রাগের কারণে হুশ হারিয়ে ফেলে যদি কেউ তালাক দেয়, তাহলে ঐ তালাক কার্যকর হয় না।
الاحالة الشرعية على المطلوب
**في”رد المحتار”(4/439) قلت: وللحافظ ابن القيم الحنبلي رح رسالة في طلاق الغضبان قال فيها إنه على ثلاثة أقسام: أحدها أن يحصل له مبادي الغضب بحيث لا يتغير عقله ويعلم ما يقول ويقصده وهذا لإشكال فيه‘ الثاني أن يبلغ النهاية فلا يعلم ما يقول ولا يريده ‘ فهذا لا ريب أنه لا ينفذ شيئ ‘ من أقواله ‘ الثالث من توسط بين المرتبين بحيث لم ءيصر كالمجنون فهذا محل النظر
** وفي”فتح القدير”(3/343) (لا يقع طلاق الصبي) وإن كان يعقل(والمجنون والنائم) والمعتوه كالمجنون قيل هو القليل الفهم المختلط الكلام الفاسد التدبير لكن لايضرب ولا يشتم بخلاف المجنون وقيل العقل من يستقم كلامه وأفعاله إلا نادرا ولامجنون ضده والمعتوه من يكون ذلك منه على السواء وهذا يؤدي إلى أن لا يحكم بالعته على أحد الأول الأولى وما قيل من يكون كل من الأمرين منه غالبا معناه يكثر منه وقيل من يفعل فعل الجانبين عن قصد مع ظهور الفساد والمجنون بلا قصد والعاقل خلافهما وقد يفعل فعل الجانبين على ظن الصلاح أحيانا والمبرسم والمغمى عليه والمدهوش كذالك
** وفي”بدائع الصنائع”(4/269) ومنها أن لا يكون معتوها و لا مدهوشا ولا مبرسما ولا مغميا عليه ولا نائما فلا يقع طلاق.
** وفي” الهندية”(1/420) لا يقع طلاق للصبي وإن كان يعقل والمجنون ‘النائم والمبرسم والمغمى عليه والمدهوش هكذا في “فتح القدير”.
** وفي”التاتارخانية”(4/392) طلاق الصبي غير واقع وكذالك طلاق المجنون والمعتوه وفي شرح الطحاوى: وكذالك المغمى عليه والمدهوش
** وفي”فتاوى دار العلوم ديوبند”(9/84) الجواب: جب غصہ اس درجہ پہنچ جاوے کہ کچھ ہوش وحواس نہ رہے تو ایسے حالت کی طلاق واقع نہیں ہوتی.** وفي راجع أيضا في “مجمع الأنهر”(2/10) و”النهر الفائق”(2/320) و”جامع الفتاوى”10/144) و”فتاوى عباد الرحمن”(5/114) و”فتاوى حقانيه”(4/448) و”فتاوى قاسميه”(14/373) و”فتاوى محموديه”(18/130).انتهى ، والله أعلم بالصواب