আল জামি'আতুল আরাবিয়া দারুল হিদায়াহ-পোরশা

ফতোয়া কী ও কেন ? ফতোয়া জিজ্ঞেস করার আদব ও নিয়মাবলি

শেয়ার করুন !!

ফতোয়া কী ও কেন?
ফতোয়া জিজ্ঞেস করার আদব ও নিয়মাবলী!

ফতোয়ার পরিচয়

ফতোয়া হচ্ছে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানকল্পে শরিয়ত কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা বলে কুরআন সুন্নাহর আলোকে প্রদত্ত সমাধান বা ফায়সালা। (কামুসুল ফিকহ ২/১৮১)

ফতোয়া কেন জিজ্ঞেস করবো?

মুসলমান হওয়ার অর্থ হল, এই অঙ্গীকার করা যে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ মেনে চলবো। এখন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ’তালা কি আদেশ কি নিষেধ শরিয়তের মূলনীতির আলোকে তা সকলের জানা থাকে না। এজন্য প্রয়োজনের সময় বিজ্ঞ আলেমের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে। আল্লামা আলূসী রহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন, ক্ষেত্র বিশেষে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা ওয়াজিব। (তাকলীদ কী শরয়ী হাইসিয়ত ২৩, কামুসুল ফিকহ ২/১২০)

কেননা আল্লাহ তাদের এরশাদ করেন-
فاسالوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
যদি জানা না থাকে তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করে নাও। (সূরা নাহল: ৪৩, সূরা আম্বিয়া: ০৭)

কী বিষয়ে ফতোয়া জিজ্ঞেস করবো

ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের এমন কোন শাখা নেই, যাতে ইসলামের কোন দিক-নির্দেশনা নেই আকীদা, ইবাদত, ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, আধুনিক সকল প্রযুক্তি ইত্যাদি সকল বিষয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট বিশদ দিক-নির্দেশনা কিংবা মূলনীতি বিদ্যমান আছে। একজন মুসলমান খাঁটি মুসলমান হওয়ার জন্য সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার যা আদেশ নিষেধ তা মেনে চলতে হবে। কেয়ামত পর্যন্ত সকল বিষয়ে ইসলাম পরিপূর্ণ সর্বোত্তম বাস্তবসম্মত যুগ চাহিদার সবচেয়ে অনুকূল আদর্শ ও ব্যবস্থা। কেননা একমাত্র ইসলামই আল্লাহ তায়ালার মনোনীত ধর্ম। আর আল্লাহ তায়ালা মহাপ্রজ্ঞাময় মহাজ্ঞানী। সুতরাং যে কোনো বিষয়ে ইসলামি বিধান জানার জন্য মুফতি সাহেবের কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করবো।

কীভাবে ফতোয়া জিজ্ঞেস করবো

কোন বিজ্ঞ মুফতী সাহেবের কাছে কিংবা দারুল ইফতায় ম্যাসেজ করে, ই-মেইল করে কিংবা ফোন করে সহজে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা যায়। সরাসরি সাক্ষাৎ করে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা উত্তম। কেননা এতে মুফতী সাহেব বিস্তারিত হালত ও অবস্থা জেনে সমাধান দিতে পারেন। মৌখিক সমাধান নেওয়ার চেয়ে নিয়মতান্ত্রিক লিখিত ফতোয়া নেওয়া উত্তম। এতে সমাধান সংরক্ষণ করা যায়। বিশেষ করে সামাজিক ও যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লিখিত ফতোয়া নেওয়া উচিত, যাতে তা প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষিত থাকে।

ফতোয়া জিজ্ঞেস করার আদব ও নিয়মাবলি

১. ফতোয়া জিজ্ঞেস করতে হবে বিজ্ঞ আলেমের কাছে যিনি গভীর ইলমের অধিকারী, নেককার ও ফতোয়া প্রদানের যোগ্য এবং যুগের ওলামায়ে কেরাম যার ফতোয়ার উপর আস্থা পোষণ করেন। (উসুলে ইফতা ওয়া আদাবুহু ৩৮৩)
২. যদি এক মুফতী সাহেবের ফতোয়ায় অন্তর আশ্বস্ত না হয় তাহলে আরেক মুফতী সাহেবকে জিজ্ঞেস করা মুস্তাহাব। তবে মুস্তাফতী যেই মাযহাবের অনুসারী সেই মাযহাবের মুফতী সাহেবকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। (উসুলে ইফতা ওয়া আদাবুহু ৩৮৬)
৩. মুফতী সাহেবের সঙ্গে আচরণে উচ্চারণে আদব বজায় রাখতে হবে। এমন কোনো আচরণ বা কথা বলা যাবে না যা বিরক্তিকর বা কষ্টদায়ক। (উসুলে ইফতা ওয়া আদাবুহু ৩৮৭) ৪. লিখিত ফতোয়া নিতে হলে মুফতী সাহেবকে ফতোয়া লিখিতভাবে প্রস্তুত করার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হবে; তাড়াহুড়া করা উচিত হবে না। তবে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা।
৫. মৌখিক ফতোয়া নিতে হলে আগে মুফতী সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। যদি ফতোয়া জিজ্ঞেস করার অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে জিজ্ঞেস করা যাবে নতুবা জিজ্ঞেস করা যাবে না। কেননা মুফতী সাহেব সব হালতে সব অবস্থায় ফতোয়া দিতে পারেন না। যেমন- রাগ, পেরেশানি, কঠিন কোন ব্যস্ততার সময় ফতোয়া দেওয়া নিয়ম পরিপন্থি। (উসুলে ইফতা ওয়া আদাবুহু ৩৮৭)
৬. এখনো ঘটেনি এমন বিষয়ে প্রশ্ন না করাই উচিত। (কামুসুল ফিকহ ২/১২২)
৭. জানার প্রয়োজন নেই এমন কোন বিষয়ে অযথা প্রশ্ন না করা। (কামুসুল ফিকহ ২/১২১)
৮. প্রশ্নকারী যিনি দলিল, দলিলের গভীরতা, বিশ্লেষণ ইত্যাদি বুঝতে সক্ষম নন তার জন্য ফতোয়ার দলিল জানতে না চাওয়া। (উসুলে ইফতা ওয়া আদাবুহু ৩৮৭)
৯. অস্পষ্ট পেঁচিদা কোন প্রশ্ন না করা। সাজিয়ে গুছিয়ে স্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন করা। (কামুসুল ফিকহ ২/২২২)
আকিদাগত এমন সূক্ষ্ম নাজুক বিষয়ে প্রশ্ন না করা যে বিষয়ে বেশি তত্ত্ব-তালাশ করতে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে। (কামুসুল ফিকহ ২/২২)
১০. মন্দ উদ্দেশ্যে কোন প্রশ্ন না করা। (উসুলে ইফতা ওয়া আদাবুহু ৩৩৯)
১১. চার মাযহাবের ঐকমত্য পূর্ণ ফতোয়ার খেলাফ কোন ফতোয়া গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং চার মাযহাবের ওই ঐকমত্য পূর্ণ ফতোয়ার খেলাফ কোন ফতোয়া গ্রহণ না করা। (তাকলীদ কী শরয়ী হাইসিয়ত ৮০)

মাযহাব কী ও কেন

মাযহাব হচ্ছে কুরআন সুন্নাহর ব্যাখ্যার ধারা। সুতরাং চার মাযহাব হচ্ছে, সারা বিশ্বের গ্রহণযোগ্য সমস্ত ওলামায়ে কেরামের নিকট শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্বীকৃত কুরআন সুন্নাহর সহিহ ব্যাখ্যার গ্রহণযোগ্য চারটা ধারা। মাযহাব কোনো ব্যক্তির মতবাদ নয়। চার মাযহাবের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য অভিন্ন। নির্দিষ্ট মূলনীতির আলোকে একাধিক মতের সম্ভাবনাপূর্ণ ক্ষেত্রে দলিলের আলোকে যেই মত অধিক শক্তিশালী সেই মত গ্রহণ করা করাই সবার উদ্দেশ্য। যে-সব শাখাগত বিধানের দলিল অস্পষ্ট শুধু সেখানে মতভেদ হয়েছে। আর যে-সব বিধিবিধানের দলিল কুরআন ও সুন্নাহয় অকাট্য, সুস্পষ্ট, সেসব বিধানে কোন মতানৈক্য হয়নি। যেমন নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত, রমজান মাসে রোযা ফরজ ইত্যাদি। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, কুরআন সুন্নাহর বিধি-বিধানের অনুসরণ। কুরআন সুন্নাহ থেকে বিধান বের করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।

সুতরাং দ্বিনের উপর চলার জন্য জরুরি কুরআন সুন্নাহ থেকে ইজতেহাদ করে বিধান বের করতে পারেন এমন মুজতাহিদ আলেমের অনুসরণ করা। আর মাযহাব হচ্ছে, কুরআন সুন্নাহর সুবিস্তৃত সুগভীর জ্ঞানের অধিকারী চার যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দেস ফকিহ বুযুর্গের কুরআন সুন্নাহর ব্যাখ্যার অনুসরণ করা। তাদের অনুসারীদের মধ্যে রয়েছেন যুগে যুগে শত শত যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দেস ফকিহ বুযুর্গ। যাদের ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত সংরক্ষিত। চার মাযহাবই হক। কিন্তু সাধারণ মুসলমান যারা বড় আলেম (আলেমে মতাবাহহির) না, তারা এক মাযহাবের অনুসরণ করবে। আর যেই মাযহাবের অনুসরণ করবে শুধু সেই মাযহাবের ফতোয়ার উপরই আমল করবে। কেননা একাধিক মাযহাবের অনুসরণ করলে ব্যক্তি দীন শরিয়তের অনুসারী থাকে না বরং প্রবৃত্তি ও খায়েশের অনুসারী হয়ে যায়। এমনকি কুফর পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। (তাকলীদ কী শরয়ী হাইসিয়ত ৬০-৬২), উসুলে ইফতা ওয়া আদাবুহু ৮৪-৮৬)

ফতোয়ার ভিত্তি

ফতোয়ার সূচনা হয়েছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। (উসুলে ইফতা ওয়া আদাবুহু ৩২/২৩) যখন ইসলাম নারীদের হক আদায়ের জোর নির্দেশ দিল এবং উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে তাদেরকেও অংশ দিল। তখন আরবদের কেউ কেউ মনে করল এটা হয়ত এক সাময়িক নির্দেশ, যা কিছুকাল পর রহিত হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে যখন রহিত হতে দেখা গেল না তখন তারা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নাজিল হয়-
يستفتونك في النساء قل لله يفتيكم فيهن.
(হে নবি) লোকে তোমার কাছে নারীদের সম্পর্কে শরিয়তের বিধান (ফতোয়া) জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, আল্লাহ তাদের সম্পর্কে তোমাদেরকে বিধান (ফতোয়া) জানাচ্ছেন….(সূরা নিসা: ১২৭)


আল্লাহ তাআলা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ফতোয়া দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন-
وانزلنا اليك الذكر لتبين للناس ما نزل اليهم ولعلهم يتفكرون.
(হে নবি) আমি তোমার প্রতি এই কিতাব নাজিল করেছি, যাতে তুমি মানুষের সামনে সেই সব বিষয়ের ব্যাখ্যা করে দাও, যা তাদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা করে। (সূরা নাহল: ৪৪)


যুগে যুগে যারা সত্যিকারের মুফতী তারা কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা দান এবং হুকুম বয়ানের ক্ষেত্রে নবি করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধি। সর্বপ্রথম এই প্রতিনিধিত্ব গ্রহণ করেছেন ঐ সব সাহাবায়ে কেরাম যারা আলেম ও ফকিহ ছিলেন, তারপর তাবেইন তাবে তাবেইন মুজাহিদীন পরবর্তী ফুকাহায়ে কেরাম। ফতোয়া প্রদানের এই ধারা এখনও অব্যাহত আছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কেননা যদি মুফতী ও ফতোয়া না থাকে এবং ফতোয়া দান ও ফতোয়া গ্রহণ না থাকে তাহলে দ্বীন বিকৃত হয়ে যাবে এবং দ্বিনের অনুসারীরা গোমরাহ হয়ে যাবে। (আলমাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যা আলকুয়েতিয়্যা ৩২/২৩)
ফতোয়া দেওয়া হয় কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াসের আলোকে এবং আসসাফ ও আকাবিরের ফতোয়ার অনুকরণে।

হাদিস শরিফে এসেছে,
قال النبي صلى الله عليه وسلم لمعاذ رضي الله عنه: كيف تقضي ؟ قال أقضي بما في كتاب الله، قال: فإن لم يكن في كتاب لله ؟ قال: فبسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: فإن لم يكن في سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم ؟ قال: أجتهد برأيي، فقال: الحمد لله الذي وفق رسول رسول الله صلى الله عليه وسلم لما يرضى رسول الله.
যখন নবি করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুয়ায বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি (ইয়ামেন গিয়ে) কীভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করবে এবং ফতোয়া দিবে ? তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালার কিতাবে যা আছে সেই আলোকে। নবি করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, যদি আল্লাহ তায়ালার কিতাবে (স্পষ্টভাবে) সে বিষয়ে কোনো বিধান না পাও ? তিনি বললেন, তাহলে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর আলোকে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, যদি সুন্নাহতেও না পাও ? তিনি বললেন, তাহলে (কুরআন সুন্নাহকে সামনে রেখে) আমি নিজে ইজতেহাদ করব।

(চিন্তা ফিকির করে কুরআন সুন্নাহর আলোকে সঠিক সমাধান বের করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব) এই জবাব শুনে নবি করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি তাঁর রসুলের প্রতিনিধিকে এমন কথা বলার তৌফিক দিয়েছেন যাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তুষ্ট। (সুনানে আবু দাঊদ ২/৫০৫)
এই হাদিসের আলোকে প্রমাণিত হলো, কিয়াসও শরিয়তের দলিল। (আলমাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যা আলকুয়েতিয়্যা ৩২/৩৩)
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে হক বোঝার হক গ্রহণ করার এবং হক্কানী রব্বানী ওলামায়ে কেরামের অনুসরণ করার তৌফিক দান করেন। আমিন
وآخر دعوانا عن الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على رسوله الكريم، والله أعلم بالصواب.


লেখক:
মুফতী আব্দুল আলিম সাহেব দা:বা:
নায়েবে মুফতী, দারুল হিদায়া, পোরশা, নওগাঁ।


শেয়ার করুন !!
Scroll to Top