আল জামি'আতুল আরাবিয়া দারুল হিদায়াহ-পোরশা

বেহেশতের নেয়ামত ও দোজখের আজাব সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা

প্রশ্নঃ মাননীয় মুফতী সাহেব হুজুর, আমি বেহেস্তের নেয়ামত ও দোজখের আজাব বিস্তারিত জানতে চাই; দয়া করে জানিয়ে বাধিত করবেন।
প্রশ্নকারীঃ মোঃ ওয়েছকুরুনী

উত্তরঃ

بسم الله الرحمن الرحيم حامدا و مصليا و مسلما

ভূমিকাঃ জান্নাতে আল্লাহ তা’আলা অফুরন্ত ও অগণিত নেয়ামত রেখেছেন; এ সকল নেয়ামতসমূহের বর্ণনা দেওয়া মানুষের ক্ষমতাবহির্ভূত; একটি হাদীসে কুদসীতে এসেছে, মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য এমন সব জিনিস প্রস্তুত রেখেছি, যা কখন কোন চক্ষু দেখেনি; কোন কান কখন শুনেনি এবং কোন অন্তকরণ যা কখন কল্পনাও করেনি। (মুসলিম শরীফ হাদীস নং-২৮২৪)

তবে কুরআন-হাদীসে যতটুকু বিবরণ এসেছে ততটুকুই শুধু আমরা জানতে পারি; এর মধ্যে কিছু নি¤েœ উল্লেখ করা হল ঃ

***وعن أبي سعيد وأبي هريرة رضي الله عنهما أن رسول الله صلي الله عليه و سلم قال ((إن أهل الجنة يتراءون أهل الغرف من فوقهم كما تتراءون الكوكب الدري الغابرفي الأفق من المشرق أو المغرب لتفاضل ما بينهم قالوا يا رسول الله تلك منازل الأنبياء لا يبلغها غيرهم قال بلي والذي نفسي بيده رجال آمنوا بالله وصدقوا المرسلين))(رواه مسلم-২৮৩১)

*** হযরত আবূ সাঈদ ও হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন,নবী করীম (সা.) বলেছেন, ((“[বেহেস্তবাসী বেহেস্তে প্রবেশের পর।] এক ঘোষক ঘোষণা করবেন: তোমরা সর্বদা সুস্থ থাকবে, অসুস্থ হবে না; সর্বদা জীবিত থাকবে, কখন মারা যাবে না; সর্বদা যুবক থাকবে, কখন বৃদ্ধ হবে না এবং সর্বদা আরামে থাকবে, কখন হতাশ হবে না।”))  (মুসলিম শরীফ হাদীস নং-২৮৩১)

*** و عن ألي رضي الله عنه قال  قال رسول الله صلي الله عليه و سلم  (( إن في الجنة لسوقا ما فيها شري و لا بيع إلا الصور من الرجال و النساء فإذا إشتهي الرجل صورة دخل فيها))  (رواه الترمذي-২৫৫০)

*** হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ((জান্নাতে একটি বাজার রয়েছে, সেখানে ক্রয়-বিক্রয় নেই; বরং তাতে নারী-পুরুষের আকৃতিসমূহ থাকবে। সুতরাং যখনই কেউ কোন আকৃতি পছন্দ করবে, সে সেই আকৃতির হয়ে যাবে।))  (তিরমিযী শরীফ হাদীস নং-২৫৫০)

*** و عن  أبي سعيد  رضي الله عنه  قال  قال رسول الله صلي الله عليه و سلم  (( أدني أهل الجنة الذي له ثمانون ألف خادم  و إثنتان  و سبعون زوجة و تنصف له قبة من لؤلؤ  و زبرجد و ياقوت كما بين الجابية إلي صنعاء و بهذا الإسناد قال من مات من أهل الجنة من صغير أو كبير يردون بني ثلثين في الجنة لا يزيدون عليها أبدا و كذلك أهل النار و بهذا الإسناد  قال إن عليهم التيجان أدني لؤلؤة  منها لتضئ  ما  بين المشرق و المغرب  و بهذا الإسناد قال المؤمن إذا إشتهي الولد  في الجنة  كان حمله  و وضعه  و سنه  في ساعة  كما يشتهي و قال إسحاق بن إبراهيم في هذا الحديث إذا إشتهي المؤمن  في الجنة الولد كان في ساعة و لكن لا يشتهي))   (رواه الترمذي-২৫৬২)

*** হযরত আবূ সাঈদ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ((নি¤œমানের  জান্নাতবাসীর জন্য আশি হাজার খাদেম ও বাহাত্তরজন স্ত্রী হবে; আর তার জন্য গম্বুজ আকৃতির ছাউনি স্থাপন করা হবে, যা মনি-মুক্তা, হীরা ও ইয়াকুত দ্বারা নির্মিত; 

উক্ত ছাউনির প্রশস্ততা জাবিয়া থেকে সানয়া পর্যন্ত মধ্যবর্তী দূরত্বের সমপরিমাণ হবে। উক্ত সনদে আর বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ 

        বলেছেন, ছোট বয়সে কিংবা বৃদ্ধ বয়সে যে কোন বেহেস্তীলোক [দুনিয়াতে] মারা যাবে, সে বেহেস্তে ত্রিশ বছর বয়সী [যুবক] হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং এ বয়সে কখন বৃদ্ধি পাবে না । দোজখবাসীরাও অনুরূপ হবে। উক্ত সনদে অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, বেহেস্তবাসীদের মাথায় এমন মুকুট রাখা হবে, যার মামুলি মুক্তা দুনিয়ার পূর্ব প্রান্ত হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত আলোকিত করবে। অত্র  সনদে অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, বেহেস্তবাসী যখন  বেহেস্তে সন্তান কামনা করবে, তখন গর্ভ , প্রসব এবং তার বয়স চাহিদা অনুযায়ী মুহূর্তের মধ্যে সংঘটিত হয়ে যাবে। ইসহাক ইবনে ইবরাহিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, মুমিন যখনই বেহেস্তে সন্তান কামনা করবে, তখনই সে সন্তান পাবে, তবে কেউ এ আকাক্সক্ষা করবে না। ))  (তিরমিযী শরীফ হাদীস নং-২৫৬২)   

***وعن ألي رضي الله عنه قال قال رسول الله صلي الله عليه وسلم ((إن في الجنة لمجتمعا للحور العين يرفعن بأصوات لم تسمع  الخلائق  مثلخا يقلن نحن الخالدات فلا نبيد  و نحن الناعمات فلا نبأس و نحن الراضيات فلا نسخط طوبي لمن كان لنا و كنا له))   (رواه الترمذي) (رواه الترمذي-২৫৬৩)

*** হযরত আলী (রা.)   হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ((বেহেস্তে হুরগণ এক স্থানে একত্রিত হয়ে সুন্দর লহরিতে গাইবে, সৃষ্টজীব সেই ধরণের লহরী কখন শুনতে পায়নি। তারা বলবে,“আমরা চিরদিন থাকব, কখন ধ্বংস হব না; সর্বদা

সুখে-সানন্দে থকব, কখন দুঃখ ও দুশ্চিন্তায় পতিত হব না; সর্বদা সন্তুষ্ট থাকব, কখন নাখোশ হব না; সুতরাং তাকে ধন্যবাদ, যার জন্য আমরা এবং আমাদের জন্য যিনি।”)) (তিরমিযী শরীফ হাদীস নং-২৫৬৩)

জাহান্নামের শাস্তিও অত্যন্ত ভয়ংকর হবে; যা বর্ণনা করার ভাষা মানুষের নেই আর জাহান্নামের আগুনও অত্যন্ত দহনক্ষমতা সম্পন্ন হবে; এ ব্যাপারে নবী করীম (সা.) এরশাদ করেন, তোমাদের আগুনের উত্তাপ জাহান্নামের আগুনের উত্তাপের সত্তর ভাগের এক ভাগ মাত্র। (মুসলিম শরীফ হাদীস নং-২৮৪৩)

এ সম্পর্কে কুরআন-হাদীস থেকে আর কিছু বিবরণ নিম্নে উল্লেখ করা হল ঃ

*** وعن أبي الدرداء رضي الله عنه قال قال رسول الله صلي الله عليه و سلم ((يلقي علي أهل النار الجوع فيعدل ما هم فيه من العذاب فيستغيثون فيغاثون بطعام من ضريع لا يسمن  و لا يغني من جوع فيستغيثون بالطعام فيغاثون بطعام ذي غصة  فيذكرون أنهم كانوا يجيزون الغصص  في الدنيا بالشراب فيستغيثون  بالشراب فيرفع إليهم الحميم بكلاليب الحديد فإذا دنت من وجوههم شوت وجوههم فإذا دخلت بطونهم قطعت ما في بطونهم فيقولون أدعوا خزنة جهنم فيقولون ألم تك تأتيكم رسلكم بالبينات قالوا  بلي قالوفادعوا  و ما دعاء الكفرين إلا في ضلل  قال فيقولون  أدعوا مالكا فيقولون يا  مالك ليقض علينا  ربك قال فيجيبهم  إنكم ماكثون  قال الأعمش  نبئت أن بين دعائهم و إجابة مالك إياهم ألف عام قال فيقولون أدعوا  ربكم فلا أحد   خير من ربكم فيقولون ربنا غلبت علينا شقوتنا  و كنا قوما ضالين ربنا أخرجنا منها فإن عدنا فإنا ظالمون قال فيجيبهم إخسئوا فيها و لا تكلمون قال فعند ذلك يئسوا من كل خير و عند ذلك يأخذون في الزفير و الحسرة و الويل)) (رواه الترمذي-২৫৮৬) 

*** হযরত আবুদ দারদা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ((দোজখবাসীকে ভীষণ ক্ষুধায় নিপতিত করা হবে এবং ক্ষুধার যাতনা সেই আজাবের সমান হবে যা তারা দোজখে ভোগ করছিল। তারপর তারা ফরিয়াদ করবে; ফলে তাদের যারী নামক এক প্রকার কাঁটাযুক্ত দুর্গন্ধময় খাদ্য দেওয়া হবে; তা তাদেরকে তৃপ্ত করবে না এবং ক্ষুধাও নিবারণ করবে না। অতঃপর পুনরায় খাদ্যের জন্য ফরিয়াদ করবে; এবার এমন খাদ্য দেওয়া হবে যা তাদের গলায় আটকে যাবে; তখন তাদের দুনিয়ার ঐ কথাটি স্মরণে আসবে যে, এভাবে গলায় কোন খাদ্য আটকে গেলে তখন পানি গিলে-গিলে তা নিচের দিকে ঢুকান হতো; সুতরাং তারা পানির জন্য ফরিয়াদ করবে, তখন তপ্ত গরম পানি লোহার কড়া দ্বারা উঠিয়ে কাছে ধরা হবে; যখন তা তাদের মুখের নিকটবর্তী  করা হবে, তখন তাদের মুখের গোস্ত পুড়ে যাবে; আর যখনই সে পানি তাদের পেটের ভিতরে ঢুকবে, তা তাদের উদরস্ত বস্তুসমূহ খ-বিখ- হয়ে যাবে। এবার তারা পরস্পর বলাবলি করবে, দোজখের রক্ষীদেরকে ডাক, তখন রক্ষীগণ বলবেন, তোমাদের কাছে কি আল্লাহর রাসূল (সা.) স্পষ্ট দলীল-প্রমাণ নিয়ে উপস্থিত হননি? তারা বলবে, “হ্যাঁ, এসেছিলেন।”  তখন রক্ষীগণ বলবেন, “তোমাদের ফরিয়াদ তোমরা নিজেরাই কর; অথচ কাফেরদের ফরিয়াদ নিরর্থক।))

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ((দোজখবাসী বলবে, “মালেককে ডাক।”  তখন তারা বলবে,“হে মালেক! তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের কাছে এই আবেদন কর, তিনি যেন আমাদের মৃত্যুদান করেন।”  উত্তরে মালেক বলবেন,“তোমরা সর্বদার জন্য এখানে এ অবস্থাতেই থাকবে।”))

অধস্তন রাবী আ’মাশ বলেন, আমাকে বর্ণনা করা হয়েছে, দোজখবাসীদের ফরিয়াদ ও মালেকের জবাবের মাঝে এক হাজার বছর অতিক্রান্ত হবে।

রাসূলুল্লাহ  (সা.) বলেন, (( দোজখীরা সর্বদিক হতে নিরাশ হয়ে বলবে, “এবার তোমরা তোমাদের প্রভূর কাছে সরাসরি ফরিয়াদ কর; তোমাদের রবের চেয়ে উত্তম অর কেউ নেই।” তখন তারা বলবে,“হে আমাদের প্রভূ! দূর্ভাগ্য আমাদের উপর প্রবল হয়ে গেছে, ফলে  আমরা গোমরা হয়েছি। হে আমাদের রব! আমাদের এ দোজখ হতে বের করে দাও; এরপর যদি আমরা নাফরমানিতে লিপ্ত হই, আমরাই হব নিজেদের উপর অত্যাচারী।”))

রাসূলুল্লাহ        বলেন, ((তখন আল্লাহ তা’আলা উত্তরে বলবেন, দূর হও; দোজখেই পড়ে থাক; তোমরা আমার সাথে আর কথা বলবে না।))

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ((এ সময় তারা আল্লাহ পাকের  কল্যাণ হতে নিরাশ হয়ে পড়বে এবং এরপর হতে তারা দোজখের মধ্যে বিকটভাবে চিৎকার ও হা-হুতাশ এবং নিজেদের উপর ধিক্কার করতে থাকবে।))   (তিরমিযী শরীফ হাদীস নং-২৫৮৬)

ফতোয়া প্রদান করেছেনঃ
মুফতি আব্দুল আলিম সাহেব (দা.বা.)
নায়েবে মুফতী, ফতোয়া বিভাগ, আল জামিয়া আল আরাবিয়া দারুল হিদায়াহ – পোরশা, নওগাঁ ।

শেয়ার করুন !!
Scroll to Top