আল জামি'আতুল আরাবিয়া দারুল হিদায়াহ-পোরশা

মাযহাব এর প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে

বরাবর,
ফতোয়া বিভাগ, আল-জামি’আতুল আরাবিয়া দারুল হিদায়া, পোরশা, নওগাঁ।
বিষয়:মাযহাব প্রসঙ্গে।
প্রশ্ন: মাযহাব কি ও এর প্রয়োজনীয়তা কি?
নিবেদক
মুহা. যোবায়ের হোসাইন
بسم الله الرحمن الرحيم،حامدا و مصليا و مسلما-
সমাধান: মাযহাব এর পরিচয় লাভ করতে হলে প্রথমে আমাদের ফিকহ এর পরিচয় জানতে হবে। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে কুরআন সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সকল হুকুম আহকামের সুবিন্যস্ত সংকলনই হচ্ছে ফিকহ। এই ফিকহের একাধিক সংকলণ বিদ্যমান ছিল, যার মধ্যে বর্তমানকাল পর্যন্ত শুধু চারটি সংকলনই স্থায়ীত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সেই সংকলনগুলো হচ্ছে:
১) ফিকহে হানাফি।
২) ফিকহে মালেকি।
৩) ফিকহে শাফেয়ী ।
৪) ফিকহে হাম্বলী।
সাধারণ পরিভাষায় ফিকহের প্রত্যেকটি সংকলন মাযহাব নামে পরিচিত। বলা বাহুল্য, এখানে মাযহাব শব্দটির অর্থ ফিকহের মাযহাব তথা ফিকহের নির্দিষ্ট একটি সংকলন। এখানে মাযহাব অর্থ দ্বীন বা আকাইদ বিষয়ে মতবিরোধকারী কোন ফিরকা নয়। কেননা ফিকহের এ মাযহাবগুলি প্রতিটি দ্বীন ইসলাম এবং শরয়ীতের অধীন এবং শরীয়ত অনুযায়ী চলারই একাধিক পথ। এই মাযহাবের ইমামগণ সবাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকিদার উপরই ছিলেন এবং সব ধরণের ভ্রান্ত আকিদা থেকে মুক্ত ছিলেন।
মাযহাবের প্রয়োজনীয়তা: মাযহাবের পরিচয় জানার পর এখন আমাদের অন্তরে যে প্রশ্নের উদয় হচ্ছে তা হল, হাদীস থাকতে মাযহাবের প্রয়োজনীয়তা কেন? মূলত মাযহাব হল: কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট বিধানাবলীর সুবিন্যস্ত ও সংকলিতরূপ এবং ইসলামী ইবাদত সমূহের নিয়ম কানুন ও পদ্ধতির সুবিন্যস্তরূপ যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে শিখিয়ে ছিলেন। তাঁরা তাবেয়ীগণকে এবং তাঁরা তাঁদের পরবর্তী লোকদেরকে শিখিয়ে ছিলেন।
মাযহাবের প্রয়োজনীয়তা কি? একটি উদাহরণ দিলে আমরা তা বুঝতে পারব। যেমন: আমরা যে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাায আদায় করি, তার তাকবীরে তাহরীমা থেকে সালাম পর্যন্ত মাসআলাসমূহ যদি আপনি হাদীসের কিতাব থেকে সংগ্রহ করতে চান, তাহলে হাদীসের এক দুটি কিতাব নয়, ‍দশ বিশ কিতাবেও তা পাবেন না। নামাযের বিবরণ সংক্রান্ত হাদীস যা একশোরও অধিক কিতাবে বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে। তা যদি আপনি এক জায়গায় করেন তারপরও আপনাকে এ সংক্রান্ত মাসআলা জানার জন্য নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে হবে।
১) নামাযের কাজসমূহের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া তৈরী করা। কেননা কোন হাদীসেই স্পষ্টভাবে এই পূর্ণাঙ্গ খসড়া উল্লেখ করা হয়নি।
২) জমাকৃত হাদীসসমূহের মধ্যে সহীহ যয়ীফ নির্ণয় করা।
৩) এই হাদীসসমূহের মধ্যে যেসব হাদীসসমূহের মর্ম শুধু আরবি ভাষার সাহায্যে নির্ধারণ করা যায় না, তার সঠিক মর্ম নির্ধারণ করা। কেননা অনেক হাদীস এমন আছে, যেখানে ভাষার বিচারে একাধিক অর্থের সম্ভবনা থাকে।
৪) আবার কিছু হাদীস এমনও আছে, যার বিধান রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু এর দলীল সে হাদীসে উল্লেখ নেই। শরীয়তের অন্যান্য দলীলের আলোকে এ ধরনের হাদীসসমূহও সনাক্ত করা জরুরি।
৫) আবার অনেক হাদীস এমনও দেখবেন যে, কোন হাদীসে রাফয়ে ইয়াদাইন করার কথা আছে, কোন হাদীসে না করার কথা। কোথাও আমীন জোরে বলার কথা এসেছে, আবার কোথাও আস্তে বলার কথা। কোন হাদীস থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ইমামের পিছনে ক্বেরাত পড়তে হয়, আবার কোন হাদীস থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ইমামের পিছনে ক্বেরাত পড়তে হয় না। এধরনের আরো অনেক বিষয় আছে। এখন এসব বিষয়ে কি কর্মপন্থা অবলম্বন করা হবে এ ফয়সালা শুধু হাদীসের অনুবাদ পড়ে করা সম্ভব নয়।
৬) উপরোক্ত হাদীসসমূহ থেকে নামাযের মধ্যকার যেসব কাজের কথা জানা গেল, তার মধ্যে কোন কাজটি ফরয, কোনটি ওয়াজিব, কোনটি সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। অনুরূপ যেসব কাজ নামাযে নিষিদ্ধ তার মধ্যে কোন কাজটি দ্বারা নামায একদম নষ্ট হয়ে যায়, কোন কাজটি দ্বারা নামায নষ্ট না হলেও নামাযের মধ্যে তা মাকরূহে তাহরীমী বা মাকরূহে তানযীহী কিংবা অনুত্তম ইত্যাদি বিষয়ের বিবরণও হাদীস শরীফে উল্লেখ নেই।
এখন আপনি চিন্তা করে দেখতে পারেন, ফুকাহায়ে কেরাম কত বড় কাজ করেছেন এবং সাধারণ মানুষের কত বড় উপকার করে গেছেন। ফুকাহায়ে কেরাম নামায সংক্রান্ত হাদীসসমূহ একত্রিত করে তার আলোকে নামাযের ধারাবাহিক পূর্ণাঙ্গ রূপটি সংকলন করেছেন। একইভাবে যাকাতের ব্যাপারে চিন্তা করুন, হজ্জের ব্যাপারে চিন্তা করুন। প্রত্যেকটি অধ্যায়েই এই সব শাস্ত্রীয় সমস্যা রয়েছে এবং উম্মাহর ফকীহগণ এসব সমস্যার সাগর পাড়ি দিয়ে কুরআনী বিধিবিধানের একটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবরূপ উপযুক্ত বিন্যাস ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সাথে পেশ করেছেন।
এছাড়া যে সমস্ত বিধিবিধান স্পষ্টভাবে কুরআন-হাদীসে বিদ্যমান নেই, শরীয়তের নীতিমালার আলোকে অর্থাৎ কিয়াসে শরয়ীর মাধ্যমে শরীয়তের মৌলিক উৎসসমূহ থেকে সেগুলোর সমাধান বের করার কাজটি সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে সকল যুগের ফকীহগণই করে গেছেন। এ সংকলন মাযহাবের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এখান থেকে এ প্রশ্নটির উত্তরও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, হাদীস থাকা অবস্থায় মাযহাবের প্রয়োজন কি? মূলত মাযহাব হাদীস থেকে বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয় বরং হাদীসেরই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং হাদীস শরীফের হুকুম আহকামেরই সুবিন্যস্ত ও সংকলিতরূপ। তাই খোদ হাদীসের জন্য এবং সহজভাবে সঠিক পন্থায় হাদীস শরীফের অনুসরণের জন্যই মাযহাবের প্রয়োজন।
এছাড়া কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, (فاسئلوا أهل الذكر انكنتم لا تعلمون) যদি তোমরা না জানো তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর। ( সূরা আম্বিয়া আয়াত-৭ সূরা নাহল আয়াত-৪৩) এ আয়াতে পূর্ণ মানবমণ্ডলীকে একটি মৌলিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যে কেউ কোন বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ কিংবা অনভিজ্ঞ হবে তার জন্য উচিত হবে সে বিষয়ে অভিজ্ঞ ও ‍বিজ্ঞজনের কাছ থেকে বিষয়টি জেনে নেওয়া এবং সে অনুযায়ী কাজ করা আর এটাকেই ইসলামী পরিভাষায় মাযহাব বলা হয়।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,(يايها الذين أمنوا اطيعوا الله واطيعوا السول واولى الامر منكم) হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর, আরো আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যে যারা “উলুল আমর” তাদের। ( সূরা নিসা, আয়াত-৫৯) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) ও হযরত মুজাহিদ ( র:) থেকে এই আয়াতে “উলুল আমর” বলতে উলামায়ে কেরামকে বুঝানো হয়েছে-এটাই যথার্থ মত।

হাদীস শরীফে এসেছে, (عن حذيفة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إني لاادرى مابقائي فيكم فاقتدوا بالذين من بعدى أبي بكرو وعمر)  হযরত হুজাইফা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি জানি না আর কতদিন তোমাদের মাঝে থাকব। সুতরাং আমার পর তোমরা দুই ব্যক্তির অনুসরণ করবে। আবু বকর এবং উমর (রা:)। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং-৩৬৬৩) এ হাদীসে হযরত আবু বকর ও উমর (রা.) এর অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
সুতরাং উল্লিখিত আয়াত ও হাদীস দ্বারা  মাযহাবের পরিচয় ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল। ( আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন: “মাযহাব ও তাকলীদ কি ও কেন?” লেখক,শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দাঃ বাঃ)।

ফতোয়া প্রদান করেছেনঃ
মুফতি আব্দুল আলিম সাহেব (দা.বা.)
নায়েবে মুফতী-ফতোয়া বিভাগ
আল জামিয়া আল আরাবিয়া দারুল হিদায়াহ-পোরশা, নওগাঁ ।

Scroll to Top