আল জামি'আতুল আরাবিয়া দারুল হিদায়াহ-পোরশা

চারিত্রিক দুর্ভিক্ষের কবলে সমাজ-সমসাময়িক লেখা

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ নিয়েই তাকে চলতে হয়। আর এভাবে চলতে গিয়ে নানামুখ সমস্যার সম্মুখীন মানুষকে হতে হয়। বর্তমানে সবচাইতে বেশী যে জিনিসের সম্মুখীন মানুষ হচ্ছে তা হলো চারিত্রিক দুর্ভিক্ষ। কারণ প্রতিটি সেক্টরে মিথ্যা, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, ভেজাল, অপরকে ঠকানো ইত্যাদি অন্যায়ে ভরপুর।দুর্ভিক্ষ কেন বললাম, কারণ দুর্ভিক্ষ (রাক্ষুসে আকাল) বলে কোন এলাকার ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি। সাধারণত ফসলহানী, যুদ্ধ, সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে। আর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে অনাহারে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করে।

তবে চারিত্রিক দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ মারা যায় না। কিন্তু তার অন্তর মরে যায়। তার মানবতা মরে যায়। তো, আজ আমাদের সমাজ চারিত্রিক দুর্ভিক্ষের কবলে। সবাই চাই অন্যের থেকে ভালো ব্যবহার পেতে, ভালো আদর্শ পেতে, কিন্তু ভালো কিছু পেতে হলে তো ভালো কিছুর অনুসরণ করতে হবে। ভালো কিছু শিখতে হবে, তাহলেই না ভালোর আশা করা যায়।

 

আপনারা জানেন যে আদর্শ দুই প্রকার
(১) أسوة حسنة উত্তম আদর্শ
(২) أسوة سيْئة অনুত্তম আদর্শ

পৃথিবীতে উত্তম আদর্শের অধিকারী ছিলেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – এটা আল্লাহ পাক নিজেই কুরআনুল কারীমে বলেছেন: لقد كان لكم في رسول الله أسوة حسنة
অর্থ: অবশ্যই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সুরা আহযাব আয়াত নং ২১)

আজ নবীজীর উত্তম আদর্শ ও চারিত্রিক গুণাগুণ না অর্জন করার কারণে অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, নির্লজ্জতা, সুদ, ঘুষ, বেহায়াপনা, সামাজিক অশ্লীলতাসহ সকল প্রকার অপকর্ম আমাদের সমাজকে বেষ্টন করে ফেলেছে। আর আমরা এ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে ঈমান হারানোর উপক্রম হচ্ছি।

মানুষের চরিত্র বড়ই মূল্যবান। এ যুগে চরিত্রবান মানুষ খুঁজে পাওয়া বড়ই কঠিন। বর্তমানে মনে হয় মানুষ জোর গলায় বলতে পারবে না যে, সে বড়ই চরিত্রবান। আর যে বলবে তাকে ধরে নিতে হবে সে বড় মিথ্যাবাদী। তবে হ্যাঁ, ছোট্ট একটা শ্রেণী আছে, যাদের ভিতর নববী আদর্শ আছে। কিন্তু তারা এ বিশাল জনসমুদ্রের তুলনায় একেবারেই সামান্য। তাহলে চিন্তা করুন, পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমন সমস্যা কেন সৃষ্টি হল?

সেক্যুলারিজম শিক্ষা, সমাজ ও রাজনীতি থেকে ইসলামের অবস্থান ও ভূমিকাকে প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ ও বিতাড়নের চেষ্টা করছে। ইসলামকে ব্যক্তি পরিসরের সবচেয়ে ক্ষুদ্র কারাগারে বন্দী করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তারা চায় না ইসলামের সৌন্দর্য সমাজ, রাষ্ট্র দেখুক। কারণ মানুষ ইসলামের আসল সৌন্দর্য ও সুফল দেখতে পেলে তা থেকে আর সরে যাবে না।

তাই এটা তারা চায় না। তারা শিক্ষা ব্যবস্থাকে এজন্যই এভাবে সাজিয়েছে যেন ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে উঠে। আর এতে তারা সিংহভাগ সফলও হয়েছে।

 

আমাদের করণীয় কী?

এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় হলো, অসৎ আদর্শ থেকে উত্তম আদর্শের দিকে আমাদের চরিত্রকে পরিবর্তন করা। কারণ আরবীতে প্রবাদ আছে—

حبة الناس ليست بالحسب والنسب ولا بالمال ولا بالذهب انما بالأخلاق والتربية والأدب
অর্থ: মানুষের ভালবাসা বংশগৌরব, আত্মীয়তা, সম্পদ ও স্বর্ণের দ্বারা হয় না। অবশ্যই তা আখলাক, শিষ্টাচার ও নৈতিকতার দ্বারা হয়। তাই আমাদেরকে উত্তম আদর্শ, ভালো চরিত্রের গুণাবলী অর্জন করতেই হবে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো উত্তম আদর্শের পূর্ণতা দেওয়ার জন্যই দুনিয়াতে এসেছিলেন।

انما بعثت لأتمم مكارم الأخلاق
(رواه البخارى في الأدب المفرود و احمد و البيهقي)
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমাকে উত্তম আদর্শের পূর্ণতা দেওয়ার জন্যই প্রেরণ করা হয়েছে।

চরিত্রের পরিবর্তন সম্ভব কী?
এ ব্যাপারে ইমাম গাজালী (রহঃ) লিখেছেন, চরিত্র পরিবর্তনশীল। যদি চরিত্র পরিবর্তন না হতো তাহলে উপদেশ, মোটিভেশন, শাসন ইত্যাদি সবই পণ্ডশ্রম হতো।

আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও বলতেন না যে তোমার আখলাককে সুন্দর করো। এমনকি এ পরিবর্তন পশু-পাখির মধ্যেও সম্ভব। বাজপাখি তার শিকারির সাথে মেশার কারণে তার স্বভাবও বদলে যায়। সে শিকার ধরে ঠিকই, কিন্তু লোভের বশবর্তী হয়ে তা আহার করে না। যখন চেষ্টা আর সাধনায় পশু-পাখির মাঝে পরিবর্তন আসে, তাহলে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসা কি অসম্ভব? (ইহয়াউল উলুম ৩/২৪৭)

শিয়াল, বাঘ, সিংহ এগুলোকে মানুষ বস করে। ফলে তারা নিজেদের স্বভাব ভুলে গিয়ে মানুষের কথার দাসত্ব করে। ভাই, এসব পরিবর্তন কি আমরা দেখি না?এগুলোই প্রমাণ বহন করে চরিত্র পরিবর্তনশীল। আর চরিত্র যেহেতু পরিবর্তনশীল তাই তো সেক্যুলাররা চরিত্রকে নেতিবাচকের দিকে মোড় ঘুরায়। আর তা ঘুরেও যায়। তাই এখন এ চরিত্রকে ইতিবাচকের দিকে মোড় ঘুরাতে হবে। আর ইসলামের আলোকে আখলাক বিনির্মাণের রূপরেখাকে অবলম্বন করতে হবে।

 

নিজেকে এ দুর্ভিক্ষ থেকে কীভাবে বাঁচাবো?

চরিত্রের অধঃপতন হলে নিজের মনকে জিজ্ঞেস করতে হয়, মনকে বুঝাতে হয়। মনকে শক্ত করতে হয় যে খারাপের কারণে আজ চরিত্রে দোষ লেগেছে, সে কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হয়। পণ করতে হয়, যে আর কোনদিন এমন কাজ করব না, চরিত্রের উপর কলঙ্ক লাগাব না। এভাবে আমাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। সব ধরনের মন্দকাজ থেকে ফিরে আসতে হবে। সৎ পথে জীবনযাপন করতে হবে। ধর্মে মনোনিবেশ করতে হবে। রবের কাছে মাফ চাইতে হবে।

জানি, বলা যতটা সহজ, করা ততটা সহজ না। এরপরেও আমাকে করতেই হবে। কারণ মন্দ চরিত্রের দংশন বড়ই কঠিন। এ দংশনের কষ্ট মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হয়। আর মৃত্যুর পর ওটা তো সবারই জানা। কেমন হবে আমার এ আচরণের বিচার। তাই দুনিয়ার সাময়িক সুখ-শান্তির কারণে আখেরাত নষ্ট করা কোন বিবেকবান মানুষের কাজ হতে পারে না।

 

শেষ কথা
অতএব ফিরে আসি, দৃঢ় ইচ্ছা করি, নববী আদর্শে আমাকে আদর্শিত হতেই হবে। নববী আলো দ্বারা আমার জীবনকে আলোকিত করতেই হবে। যদি ইচ্ছা করি তাহলে সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। ইংরেজীতে একটা প্রবাদ বাক্য আছে: “where there is will there is way ”  ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।

তাহলে দৃঢ়ভাবে ইচ্ছা করি আল্লাহ কবুল করবেন, ইনশা আল্লাহ।


 

শেয়ার করুন !!
Scroll to Top