জান্নাতের উত্তম প্রতিদান প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতিঃ
সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত জামাত। দুনিয়াতে থাকতেই তাঁরা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে জান্নাতের মহা প্রতিদান প্রাপ্তির সুসংবাদ ও প্রতিশ্রুতি লাভ করছেনে ।
ইরশাদ হয়েছে,
لَٰكِنِ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ ۚ وَأُولَٰئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ . أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
কিন্তু রাসূল এবং যে সকল লোক তার সঙ্গে ঈমান এনেছে, তারা নিজেদের জান-মাল দ্বারা জিহাদ করেছে। তাদেরই জন্য সর্বপ্রকার কল্যাণ এবং তারাই কৃতকার্য। আল্লাহ তাদের জন্য এমন সব উদ্যান তৈরি করে রেখেছেন, যার তলদেশে নহর বহমান, যাতে তারা সর্বদা থাকবে। তাই মহাসাফল্য। -সূরা তাওবাহ : ৮৮,৮৯
সূরা তাওবার ১০০ নম্বর আয়াতে আগে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে আনসার এবং মুহাজিরদের প্রতি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং প্রস্তুতকৃত এমন জান্নাতসমূহের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত।
সূরা তাওবায় ইরশাদ হয়েছে,
الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللَّهِ ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ . يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُمْ بِرَحْمَةٍ مِنْهُ وَرِضْوَانٍ وَجَنَّاتٍ لَهُمْ فِيهَا نَعِيمٌ مُقِيمٌ . خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ
যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহর পথে হিজরত করেছে এবং নিজেদের জান-মাল দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহর কাছে মর্যাদায় অনেক শ্রেষ্ঠ এবং তারাই সফলকাম।তাদের প্রতিপালক তাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে রহমত, সন্তুষ্টি ও এমন উদ্যানসমূহের সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার ভেতর তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী নি‘আমত। তারা তাতে সর্বদা থাকবে নিশ্চয়ই আল্লাহরই কাছে আছে মহা প্রতিদান। -সূরা তাওবা: ২০-২২
আয়াতে মুহাজির সাহাবীদেরকে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি,রহমত ও জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। -আত তাহরীর ওয়াত তানবীর, ১০/১৫০
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
لَا يَسْتَوِي مِنْكُمْ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ ۚ أُولَٰئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الَّذِينَ أَنْفَقُوا مِنْ بَعْدُ وَقَاتَلُوا ۚ وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَىٰ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
অর্থ: তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের আগে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে তারা (পরবর্তীদের) সমান নয়। মর্যাদায় তারা সেই সকল লোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যারা (মক্কা বিজয়ের) পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সকলকেই, তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত। সূরা হাদীদ: ১০
প্রতিশ্রুত কল্যাণ দ্বারা উদ্দেশ্য হল জান্নাতের নেয়ামতরাজি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল সাহাবীকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে মক্কা বিজয়ের পূর্বে যে সকল সাহাবী আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছেন, জিহাদ করেছেন তাঁদেরকে মক্কা বিজয় পরবর্তী সাহাবীদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে। কারণ পূর্ববর্তীদের দ্বীন ও ঈমানের ক্ষেত্রে অগ্রগামীতার পাশাপাশি যে ত্যাগ তিতিক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে পরবর্তীদের সইে পরিমাণ ত্যাগ তিতিক্ষার সম্মুখীন হতে হয়নি।
আয়াত থেকে স্বতঃসিদ্ধ এ বিষয়টিও প্রতীয়মান হয় যে সাহাবাপরবর্তী কেউ ঈমান আমলে কোন সাহাবীর সমকক্ষ হতে পারবে না। এর একটি মৌলিক কারণ তো হলো তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সোহবতের মতো মহা নেয়ামত লাভ করেছেন। দ্বিতীয়তঃ দ্বীনের জন্য তাঁদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও কুরবানীর অবদান পরবর্তীদের মেহনত মুজাহাদার তুলনায় অনেক বেশি। -তাফসীরে কাবীর, ২৯/৪৬৩, তাফসীরে ইবনে কাসীর ৭/১৭৪,তাফসীরে মাজহারী ৯/১৯১
সাহাবায়ে কেরাম রা. পরবর্তীদের জন্য অনুসরণীয়ঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর উম্মতের সর্বোত্তম আদর্শ হলেন সাহাবায়ে কেরাম রা.। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর ভাষায়
من كان منكم متأسيا فليتأس بأصحاب محمد صلى الله عليه و سلم فإنهم كانوا أبر هذه الأمة قلوبا و أعمقها علما و أقلها تكلفا و أقومها هديا و أحسنها حالا. قوم اختارهم الله لصحبة نبيه صلى الله عليه وسلم فاعرفوا لهم فضلهم واتبعوهم في آثارهم فإنهم كانوا على الهدي المستقيم.
অর্থঃ তোমাদরে কওে যদি কারো আর্দশ অনুসরণ করতে চায় তাহলে সে যনে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণকেই আদর্শরূপে গ্রহণ করে। কারণ হৃদয়ের পবিত্রতায়, ইলমের গভীরতায়, আড়ম্বরহীনতায়, সঠকি পন্থা অবলম্বন ও উত্তম হালতরে ববিচেনায় তাঁরা ছিলেন এ উম্মতের শ্রেষ্ঠ জামাত। আল্লাহ তাঁদেরকে আপন নবীর সাহর্চযরে জন্য মনোনীত করেছিলেন। সুতরাং তোমরা তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবন কর এবং তাঁদের পথ অনুসরণ কর। নিঃসন্দেহের তাঁরাই ছিলেন সরল পথের পথিক। -জামেউ বয়ানিল ইলম বর্ণনা : ১৮১০
দ্বীনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম আমাদের জন্য অনুসরণীয়। কারণ তাঁরাই ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ যারা সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছ থেকে তাঁর আনীত দ্বীন ও আদর্শ গ্রহণ করেছেন। নিজেদের মাঝে তা পরিপূর্ণভাবে ধারণ করেছেন এবং পূর্ণ নিষ্ঠা ও আমানতদারিতার সাথে পরবর্তীদের কাছে পৌঁছিয়েছেন। দ্বীনের সঠিক বুঝ হাসিল করতে হলে, দ্বীনের প্রতিটি বিষয় যথাযথভাবে যিন্দেগীতে প্রয়োগ করতে হলে তাঁদের আদর্শ অনুসরণের বিকল্প নেই। তাঁদের আদর্শ মূলত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরই আদর্শ। তাঁরাই হলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শের বাস্তব নমুনা। এজন্য কুরআন কারীমে তাঁদের অনুসরণের বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে পেশ করা হয়েছে।
সূরা তাওবার ১০০ নং আয়াতটি আবার লক্ষ্য করি।
ইরশাদ হয়েছে,
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ
মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা (ঈমানে) প্রথমে অগ্রগামী হয়েছে এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে।
আয়াতে যারা সাহাবায়ে কেরামের ইত্তিবা ও অনুসরণ করে তাদের প্রতিও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টির ঘোষণা এসেছে। লক্ষণীয় হলো, এখানে ইহসান এর সাথে তাঁদের ইত্তিবা ও অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। যার দাবি হলো, তাঁদের অনুসরণের পাশাপাশি অন্তর থেকে তাঁদের মুহাব্বত করা। তাঁদের জন্য কল্যাণ ও মাগফিরাতের দুআ করা। তাঁদের কারো ব্যাপারে কোন মন্দ ধারণা পোষণ না করা এবং তাঁদের শানে আঘাত হানে এমন কোন কথা না বলা। ইত্তিবা বি ইহসান এর মধ্যে এ বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর অনুপস্থিতিতে কোনভাবেই সাহাবায়ে কেরামের পূর্ণাঙ্গ ইত্তিবা ও অনুসরণের দাবি করা যায় না। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/২০৩, ৭/২৩১, বয়ানুল কুরআন ২/৩২০
কুরআন কারীমের একাধিক আয়াতে সাহাবায়ে কেরামের বিভিন্ন গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের আলোচনা করা হয়েছে। সেগুলোর কিছু বর্ণনা সামনে আসছে। সাহাবায়ে কেরামের ঐ গুণাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রেও একটি মৌলিক উদ্দেশ্য হল, পরবর্তীদেরকে তাঁদের আদর্শ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করা। -মাআরিফুল কুরআন ৮/৯২
সাহাবায়ে কেরামের প্রতি কোন বিদ্বেষ না রাখা, তাঁদের জন্য দুআ ও মাগফেরাত কামনা করাঃ সাহাবাপরবর্তী উম্মতের উপর সাহাবায়ে কেরামের অনেক বড় হক যে, তাঁরা তাঁদের সকলকে মুহাব্বত করবে। তাঁদের জন্য কল্যাণ ও মাগফেরাতের দুআ করবে। তাঁদের কারো প্রতি কোন প্রকার বিদ্বেষ রাখবে না। কারণ সাহাবায়ে কেরামের মেহনত ও কুরবানীর বদৌলতেই তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনীত এই দ্বীন লাভ করেছে। তাই ইনসাফের দাবি হলো তারা সকল সাহাবীদের প্রতি কৃতজ্ঞতার মানসিকতা লালন করবে। যার ন্যূনতম প্রকাশ হলো তাঁদের প্রতি মুহাব্বত রাখা, তাঁদের জন্য দুআ করা। কুরআনে সাহাবা পরবর্তী উম্মতকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই নির্দেশনাই দিয়েছেন।
সূরা তাওবার ১০০ নং আয়াতের আলোচনায় আমরা দেখেছি ‘‘ইত্তিবা বি ইহসান” এর মধ্যে উপরোক্ত বিষয়গুলো শামিল।
সূরা হাশরে ইরশাদ হয়েছে,
وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
এবং (ফায়-এর সম্পদ) তাদেরও প্রাপ্য, যারা তাদের (অর্থাৎ মুহাজির ও আনসারদের) পরে এসেছে। তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! ক্ষমা কর আমাদেরকে এবং আমাদের সেই ভাইদেরকেও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে এবং আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি কোন হিংসা-বিদ্বেষ রেখ না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি অতি মমতাবান, পরম দয়ালু। -আল-হাশ্র: ১০
সূরা হাশরের এই আয়াত এবং এর আগে উল্লেখিত আয়াতগুলোতে “ফায়”( ) এর হকদার প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে এবং এখানে সকল প্রকার মুমিনের কথা এসেছে।
প্রথমে মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের কথা এসেছে। এরপর উল্লেখিত আয়াতে তাঁদের পরে আগত অন্যান্য মুমিনদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর তাঁদের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে যে তারা সাহাবায়ে কেরামের জন্য মাগফেরাতের দুআ করবে। তাঁদের ব্যাপারে নিজের অন্তরকে পরিষ্কার রাখবে। তাঁদের প্রতি কোন হিংসা-বিদ্বেষ রাখবে না। তাই মুমিন হিসেবে আমাদের প্রত্যেককেই এই বিষয়গুলো নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে হবে। এটাই প্রকৃত ঈমানের তাকাযা। -তাফসীরে কাবীর, ২৯/৫০৯
চলমান……