Home » ব্লগ » ফতোয়া বলতে কি বুঝায়, এর ভিত্তি এবং ইতিহাস ?

ফতোয়া বলতে কি বুঝায়, এর ভিত্তি এবং ইতিহাস ?

সালিশ বা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানকে ফতোয়া বলা হয়। ফতোয়া কার্যকর করার বিষয়ে শরীয়তের যেসব মৌলিক বিধিবিধান রয়েছে সে সম্পর্কে আমাদের সমাজে অজ্ঞতা ও উদাসীনতা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এজন্য ফতোয়া এবং এ সংক্রান্ত মৌলিক বিধি-বিধান সম্পর্কে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষকে সচেতন করা সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি। আজকের আলোচনায় এ বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ও এর ইতিহাস নিয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত আকারে প্রামাণিক আলোচনা করার চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ-

ফতোয়া

ফতোয়া আরবি শব্দ এবং কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়তের একটি মর্যাদাপূর্ণ পরিভাষা।বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে ‘ফতোয়া’ সংক্রান্ত আরো কিছু শব্দের অর্থ জেনে নেয়া আবশ্যক।যথা- ইস্তিফতা, মুসতাফতি, মুফতি, ইফতা ও দারুল ইফতা।ফতোয়া বা ফাতওয়া ( فتوى‎) বহুবচন ফাতাওয়া (فتاوى‎) হলো বিধান ও সমাধান, যা কোনো ঘটনা বা অবস্থার প্রেক্ষিতে ইসলামী শরীয়তের দলীলের আলোকে মুফতি বা ইসলামী আইন-বিশেষজ্ঞ প্রদান করে থাকেন।যখন কোনো ব্যক্তি সরাসরি কুরআন ও হাদিস কিংবা ফিকহের আলোকে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান বের করতে অপারগ হন তখন তিনি মুফতির কাছে এই বিষয়ক সমাধান চান। এটিকে ইসলামের পরিভাষায় ইস্তিফতা (اِسْتِفْتَاء) বলে। মুফতি তখন ইসলামী শরিয়তের আলোকে সমস্যার সমাধান জানিয়ে দেন। এই সমাধান প্রদান করাকে ইসলামের পরিভাষায় ইফতা (إِفْتَاء ) বলে এবং প্রদত্ত সমাধান বা বিধানটিকে ফতোয়া বলে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “যদি তোমাদের কোনো বিষয়ে জানা না থাকে, তবে আহলুজ জিকির তথা জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো।” [সূরা: নাহল, আয়াত নং- ৪৩]

ফতোয়া সংক্রান্ত শব্দসমূহ গুলোর অর্থ

১. اِسْتِفْتَاء (ইস্তিফতা) কোনো বিষয়ের ওপর ফতোয়া প্রার্থনা করা বা শরীয়তের বিধান জানার জন্য সমস্যার কথা বলা , জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন বা প্রশ্নপত্র,

২. مُسْتَفْتِي (মুস্‌তাফতী) যিনি প্রশ্ন করেন বা প্রশ্নকর্তা ,

৩. اِسْتَفْتَى (ইস্‌তাফতা) যে ফতোয়া প্রার্থনা করল, যে মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করল,

৪. يَسْتَفْتِي (ইয়াস্‌তাফতী) যে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করছে বা যে মাসআলা জানতে চায়। বহুবচনে ইয়াস্‌তাফতূনা, ইয়াস্‌তাফতূনাকা তারা আপনাকে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করে,

৫. أَفْتَى/أفتوا (আফতা) যিনি ফতোয়া দিলেন, শরীয়তের বিধান বর্ণনা করলেন, প্রশ্নের উত্তর দিলেন,

৬. يُفْتِي/يفتيكم (ইউফ্‌তী) যিনি ফতোয়া দিচ্ছেন, শরীয়তের বিধান বর্ণনা করছেন,

৭. إِفْتَاء (ইফ্‌তাউন) ফতোয়া প্রদান করা, শরীয়তের বিধান বর্ণনা করা,

৮. مُفْتِي (মুফতী) ফতোয়া দানকারী ফকীহ/মাহির আলিমে দ্বীন,

৯. فَتْوَى/فُتيا (ফত্‌ওয়া) ইস্‌তিফতার উত্তরে শরীয়তের দলীলের আলোকে প্রদত্ত শরীয়তের বিধান/সমাধান। বহুবচনে ফাতাওয়া, ফাতাভী,

১০. دَارُ الاِفْتَاء (দারুল ইফ্‌তা) যে প্রতিষ্ঠান থেকে ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব পালন করা হয়।

ফতোয়া সম্পর্কে কুরআনের বাণী

আল্লাহ পাক কুরআনে বলছেন,“তোমরা কোনো কিছু না জানলে জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে থেকে জেনে নিও।”[সূরা: আম্বিয়া, আয়াত নং-২৩] কুরআনে ফতোয়া শব্দটি বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।যেমন: পরামর্শের ব্যাপারে কুরআনে বলা হয়েছে, “বিলকীস বলল, হে পরিষদবর্গ, আমাকে আমার কাজে পরামর্শ দাও। তোমাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোন কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না”। [সূরা: নমল, আয়াত নং-৩২]

ব্যাখ্যা প্রদানে বলা হয়েছে,“আপনি আমাদেরকে এ স্বপ্ন সম্পর্কে পথনির্দেশ প্রদান করুন; যাতে আমি তাদের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের অবগত করতে পারি।” [সূরা: ইউসুফ, আয়াত নং-৪৬] শরীয়তের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,”তোমার নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। বলে দাও যে এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ এবং হজ্বের সময় ঠিক করার মাধ্যম।” [সূরা: আল-বাকারা, আয়াত নং-১৮৯] কুরআনে বলা হয়েছে, “তারা আপনাকে কালালা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছে?” আল্লাহ আরো বলেন, “…তারা আপনার কাছে নারীদের বিবাহের অনুমতি চায়। বলে দিন- আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাদের সম্পর্কে অনুমতি দেন…”[সূরা : আন-নিসা, আয়াত নং -১২৭] “মানুষ আপনার নিকট ফতোয়া জানতে চায় অতএব, আপনি বলে দিন, আল্লাহ্ তোমাদিগকে কালালাহ এর মীরাস সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নির্দেশ বাতলে দিচ্ছেন…” [সূরা : আন-নিসা, আয়াত নং -১৭৬]

এছাড়াও বহু হাদীসে ফতোয়ার ব্যবহার হয়েছে। সহীহ মুসলিমে ৪ বার,আহমদ ১২ বার, নাসাই এ ২বার,আবূ দাউদ এ ৩ বার,ইবনে মাজাহতে আছে ২ বার,দারিমীতে রয়েছে ৭ বার।এভাবে করে বহুবার ফতোয়া শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সুনানে দারিমীতে বলা হয়েছে, “যে ফতোয়া প্রদানে দুঃসাহস দেখান সে জন জাহান্নামে প্রবেশের দুঃসাহস দেখাচ্ছেন।”রাসূল(সঃ) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো বিষয় জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও সে বিষয়ের সমাধান দিল তাহলে তার গুনাহ তার উপর বর্তাবে।”

ফতোয়ার ভিত্তি

ফতোয়ার ভিত্তি হল চারটি আর তা হল কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং কিয়াস। মুহাম্মদ(সঃ) যখন মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) কে ইয়ামেনের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তখন মুহাম্মদ(সঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী দিয়ে তুমি বিচার করবে? তিনি উত্তরে বললেন, “আল্লাহর কিতাবেরর দ্বারা করব।”তখন মুহাম্মদ(সঃ) বললেন, “যদি কুরআনেও তার সমাধান না পাও তাহলে তার সমাধান কীভাবে করবে?” তখন মুয়াজ (রাঃ) বললেন, “হাদীসের দ্বারা।” তখন মুহাম্মদ (সঃ) বললেন, যদি তার সমাধান হাদীসেও না পাও তখন কী করবে? তখন সে উত্তরে বললেন, আমার বিবেকের সাহায্যে সমাধান করব”। তার এই জবাব শুনে মুহাম্মদ(সঃ) সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন আর আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। উমর (রাঃ) এর সময় প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি লিখেছিলেন, তুমি যদি কোন বিষয়ের সমাধান দিতে চাও তাহলে তা কুরআনে পাও তাহলে আর হাদীসে তা ঘাটবে না। তারপর যদি কুরআনে না পাও তাহলে হাদীস ঘাটবে আর যদি সেখানে সমাধান পাও আর কিছু খোঁজার দরকার নেই। আর কুরআন-হাদীসে যদি কোনো কিছুই না পাও তাহলে কুরআন-হাদীস ঘাটবে এবং ইজতিহাদ করে যা পাও তার আলোকেই তুমি সমাধান দিয়ে দিবে। তা আমি উমার মেনে নিব।

যিনি ফতোয়া দিতে পারবেন

কেবল মাত্র মুফতীগণ ফতোয়া দিতে পারবে।যারা ফতোয়া দিতে পারবে তাদের যোগ্যতা ও গুণাগুণ নিম্নে তুলে ধরা হল-

১. মুসলিম হওয়া,

২. ফিকহ উসূলে ফিকহ, নাসিখ এবং মানসূখ সম্পর্কে অবহিত হওয়া ৩. হালাল, হারাম, ফরয, সুন্নাত, ওয়াজিব, নফল, মুবাহ,মাকরুহ তাহরীমী এবং তানযীহী সম্পর্কে জানা

৪. কুরআন, হাদীস, ফিকহ সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া,

৫. সকলকে তার দৃষ্টিতে সমান হতে হবে,

৬. সমকালীন বিষয়য়াদী সম্পর্কে জ্ঞান রাখা,

৭. উপযুক্ত মুফতীর কাছে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা,

৮. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।

ফতোয়াদানের শর্তাবলী

১. মৌখিকভাবে ফতোয়া দিয়ে পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েজ নয়। তবে লিখিতভাবে হলে তা নেয়া যায় তবে না নেয়াই উত্তম,

২. পরামর্শের মাধ্যমে ফতোয়া প্রদান,

৩. প্রশ্ন করার পর সমতার ভিত্তিতে মুফতীর রায় প্রদান যাতে ফিৎনা সৃষ্টি না হয়,

৪. প্রশ্নকারীর অস্পষ্টতা স্পষ্ট করতে হবে,

৫. সহজ, সরল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় ফতোয়া প্রদান করতে হবে,

৬. আকীদা এবং ইবাদত সংক্রান্ত বিষয় ফতোয়া সরাসরি কুরআন-হাদীস থেকে দিতে হবে। সমকালীন বিষয়ে ফিকাহের কিতাব থেকে ফতোয়া দিবে,

৭. বিরক্ত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় ফতোয়া দেয়া,

৮. নিজ মাযহাবের উপর ভিত্তি করে ফতোয়া প্রদান।

ফতোয়া লিখার নিয়মাবলীঃ

১. লিখা সুন্দর ও স্পষ্ট হওয়া,

২. বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম উল্লেখ করা,

৩. ফতোয়া লিখা শেষে আল্লাহ ভাল জানেন এই কথাটি লিখা,

৪. ফতোয়া লিখা শেষ হলে তারিখ দেওয়া।

পরিশেষে বলা যায় যে, ফতোয়া অবশ্যই শরিয়তসম্মত হওয়া উচিত। ইসলামিক দলিল ছাড়া ফতোয়া দেয়া উচিত নয়। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকেই দ্বীনের রাস্তায় চলার তৌফিক দান করুন। আজকের আলোচনায় ফতোয়া কী, এর কুরআনিক দলিল ও ভিত্তি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। পরবর্তী আলোচনায় ফতোয়ার ইতিহাস সম্পর্কে তুলে ধরা হবে।

মুফতি আব্দুল আলিম সাহেব (দা.বা.)
নায়েবে মুফতী, ফতোয়া বিভাগ, আল জামিয়া আল আরাবিয়া দারুল হিদায়াহ – পোরশা, নওগাঁ ।

Print Friendly, PDF & Email
শেয়ার করুন
Scroll to Top
@media print { @page { margin: 5mm !important; text-align: left; } }