বরাবর,
ফতোয়া বিভাগ, আল-জামিআ‘তুল আরাবিয়া দারুল হিদায়া,পোরশা,নওগাঁ।
বিষয়: বিবাহ ও তালাক প্রসঙ্গে।
প্রশ্ন: আসসালামু আলাইকুম মুহতারাম, ভীষণই নিরুপায় হয়ে প্রশ্নটি এখানে করছি। আশা করি উত্তর দেবেন, আল্লাহ আপনাকে/আপনাদেরকে উত্তম বিনিময় দিক। অনেক বড় ঘটনা যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বলছি, আমার প্রায় সাড়ে ৬ বছর হলো বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যে ৬ বছরই আমার স্বামী স্টুডেন্ট ছিলো, তার বেকার জীবনের সাথী হয়ে বিবাহিত জীবনের ছয়টা বছর আলহামদুলিল্লাহ বেশ সুখেই কাটিয়েছি, আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছিলেন, বহু আর্থিক কষ্ট ছিলো, কিন্তু ভালোবাসা ও মহব্বতের কোনো কমতি ছিলো না, তো তার পড়াশোনা শেষে গত জানুয়ারি মাস থেকে সে চাকরীতে জয়েন করে আমাকে রেখে ঢাকা আসে এবং ঢাকায় একাই ম্যাসে থাকতো সে, এমতাবস্থায় ঢাকাতেই একটা ভীষণই আলট্রা মর্ডান শার্ট-প্যান্ট পরনেওয়ালা ডিভোর্সি মেয়ের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়, প্রায় দুইমাস তাদের ফোনে কথা ও দেখা সাক্ষাৎ হতো। এখানে বলে রাখি আমার স্বামী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হলেও প্রথম জীবনে সে “শরয়ে বেকায়া” পর্যন্ত কওমী মাদরাসায় পড়াশোনা করেছে যার দরুন এখনও সে পাঞ্জাবি-পায়জামা পড়ে এবং এজন্য হয়তো কিছুটা আল্লাহভীতী থেকে এই প্রেমের সম্পর্কটাকে হালাল করার জন্য আমার স্বামী তাকে অল্পদিনের পরিচয়েই বিয়ে করে ফেলে, তাও আমাকে না জানিয়েই। তো আমার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের কিছুদিন পরেই আমি কোনোভাবে জানতে পারি তার বিয়ের বিষয়ে এবং সব জানার পর আমার অভিভাবকসহ তাদের দুজনকে নিয়ে বসা হয়, সেখানে আমার অভিভাবকরা আমার স্বামীকে বলে দুইজনের যেকোনো একজনকে তালাক দিতে হবে, তখন আমার স্বামী আমাকে আলাদা ডেকে তার ২য় স্ত্রীকে মেনে নিতে অনুরোধ করে। এখানে আমি জানি দ্বিতীয় বিয়ে জায়েজ, আমাকে না জানিয়ে করলেও জায়েজ, তবে আমার আপত্তির জায়গা ছিলো কয়েকটা…… প্রথমত, বিবাহের পূর্বে ওই মেয়ের সাথে আমার স্বামীর ২ মাসের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো, যেটা পুরোপুরি পরকিয়া ও যেনা, সে আমাকে রেখে একা ঢাকা এসে অন্য পরনারীর সাথে সম্পর্ক করে আমার আমানতের খিয়ানত করেছে, আমার সাথে প্রতারণা করেছে। এই পরকিয়া ও যেনাকে হালাল করার জন্য করা বিয়ে আমি মানি না। দ্বিতীয়ত, আমার স্বামীর বর্তমান ইনকামে ঢাকা শহরে একটা স্ত্রীর ঠিকমতো ভরণপোষণ দেয়াই অনেক কঠিন, তার পক্ষে দুই স্ত্রীর ভরণপোষণ দেয়া অসম্ভব, সে তার বাবা-মাকেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে খরচ দিতে পারেনা। তার মানে ২য় বিয়ের জন্য সে আর্থিকভাবেও অসমর্থ। তাছাড়া সে ওই মেয়ের সাথে সম্পর্কের শুরু থেকেই অফিসের ব্যস্ততা দেখিয়ে আমাকে অবহেলা করতো, সময় দিতোনা, ফোন করতো না, ফোন করলেও বেশিক্ষণ কথা বলতো না, ২য় বিয়ের পর থেকে রাতে ফোন বন্ধ রাখতো, এটা প্রমাণ করে যে সে একজনকে পেলে আরেকজনকে ভুলে যায়, সমতাবিধানও করতে পারবে না। আর তৃতীয়ত আমি জেনারেল পড়ুয়া হলেও বিয়ের আগে থেকেই শালীন ছিলাম, আমার শালীনতায় মুগ্ধ হয়েই সে আমাকে বিয়ে করেছিলো, বিয়ের পর থেকে এখন অবধি তার কথা শুনে পরিপূর্ণ পর্দা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, আর তার ২য় পক্ষ শার্ট-প্যান্ট পড়ে, কানে তিনটা করে ফুটো, হাতে সবসময় নেলপলিশ লাগানো থাকে। ফ্রী মিক্সিং পরিবেশে পশ্চিমা পোশাক পড়েই চাকরি করে, নারী-স্বাধীনতায় চরম বিশ্বাসী। অথচ আমার স্বামী আমাকে বিয়ের পর থেকেই বলতো চাকরি করতে দেবেনা, পর পুরুষের সামনে যেতে দেবেনা।আমার স্বামীকে দেখাতে ওই মেয়ে বিয়ের পর কিছুদিন বোরকা পড়তো, তালাক দেবার পর থেকে আবার সব বাদ দিয়েছে। এমন মেয়েরা সতীন হিসেবে কেমন হবে বলাই বাহুল্য। আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় যে স্বামীকে বিয়ের পর থেকে আজ অবধি স্বেচ্ছায় কোনোদিনও পাঞ্জাবি বাদে শার্ট-প্যান্ট পরতে দেখিনি তার আজ রুচির কি পরিবর্তন!! সে নিজে ওসব পরেনা, অথচ বউকে ওমন দেখে সহ্য করে, শয়তান কতটা অন্ধ করে রেখেছে তাকে। আশা করি আমার আপত্তির জায়গাগুলো বুঝতে পেরেছেন। এসব কারণে আমি তার ২য় স্ত্রীকে মেনে নিতে অসম্মতি জানাই এবং যেকোনো একজনকে তালাক দিতে হবে বলি, সে কাউকেই তালাক দিতে রাজি না হলে আমি আবেগের বশে আত্নহত্যা করবো বলে হুমকিও দেই, সেখানে পরিস্থিতির স্বীকার হয়েই হোক আর আমাদের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের কথা ভেবেই হোক সে তার ২য় স্ত্রীকে তালাক দিতে স্বীকার হয় এবং ৪/৫ জন সাক্ষীর সামনেই মৌখিকভাবে “তোমাকে এক তালাক দিলাম,দুই তালাক দিলাম, তিন তালাক দিলাম” এভাবে ওই মেয়েকে এক বৈঠকেই পর পর তিন তালাক দেয়। এখন সমস্যা হচ্ছে এ ঘটনার কিছুদিন পরে আমার স্বামীর মোবাইলে আবারও ওই মেয়ের সাথে যোগাযোগ ও দেখা-সাক্ষাতের প্রমাণ পাই, আমার স্বামী এই তালাক কিছুতেই মানছে না, সে বলে জোরপূর্বক মনের বিরুদ্ধে দিলে নাকি তালাক হয়না, কিন্তু আমাদের হানাফী মাযহাব মতে তাদের তিন তালাক কিন্তু হয়ে গেছে, তবুও সে তালাকের পরোয়া না করেই ওই মেয়ের সাথে ফোনে যোগাযোগ ও দেখা সাক্ষাৎ বজায় রেখেছে, আমার কথা সে শোনে না, আমি অভিভাবকদের কাছে অভিযোগ জানাতে চাইলে সে আমাকে হুমকি দেয় সব ছেড়ে সে একদিকে চলে যাবে, জীবন চিল্লা দিবে এমন ভয় দেখায়। 👉এমতাবস্থায় আমার প্রথম প্রশ্ন তাদের কি সত্যি তালাক হয়নি? এখনও দেখা-সাক্ষাৎ, যোগাযোগ করা কি জায়েজ? 👉২য় প্রশ্ন: উপরে তার ২য় বিয়ে না মেনে নেবার জন্য আমার আপত্তির জায়গাগুলো বলেছি, এগুলো বিবেচনায় তাকে তালাক দিতে জোর করা কি আমার জায়েজ হয়েছে? 👉৩য় প্রশ্ন: যদি তালাক হয়ে গিয়েই থাকে তাহলে আমার স্বামী এখন যে আমাকে ভয় দেখিয়ে যিম্মি করে হারাম সম্পর্কটাকে রেখেই চলেছে এ অবস্থায় আমার করণীয় কি? আমি এখন কি করবো? দয়া করে একটু পরামর্শ দেবেন ভীষণ অসহায় হয়ে প্রশ্নটি করছি। আমার বাবা মারা গেছেন ছোট বেলায়, কোনো ভাই নেই, দায়িত্বশীল শক্ত কোনো অভিভাবক নেই যে আমার পক্ষ নিয়ে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে কথা বলবে। মানসিকভাবে আমি ভীষণই বিপর্যস্ত, অনুগ্রহ করে আল্লাহর ওয়াস্তে উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন জনাব।
নিবেদক
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
بسم الله الرحمن الرحيم،حامدا و مصليا و مسلما-
সমাধান: প্রশ্নোক্ত বিবরণ যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আপনার স্বামী তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে “তোমাকে এক তালাক দিলাম,দুই তালাক দিলাম,তিন তালাক দিলাম” বলার কারণে ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী দ্বিতীয় স্ত্রীর উপর তিন তালাক কার্যকর হয়ে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তারা একে অপরের জন্য সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে গেছে। কেননা মনের বিরুদ্ধে একই বৈঠকে তিন তালাক দিলেও তিন তালাকই কার্যকর হয়। আর তিন তালাক হয়ে যাওয়ার পরপরই ঐ স্ত্রী স্বামীর কাছে বেগানা নারীতে পরিণত হয়ে যায়। তাই তার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ,মেলামেশা বা স্বামী স্ত্রী সুলভ যে কোন আচরণ সম্পূর্ণরূপে অবৈধ ও মারাত্মক গুনাহের কাজ।
আর প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনার স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করার কারণে যদি আপনার হক ঠিকমত আদায় না করে তাহলে নিজের জন্য তালাক চাওয়া জায়েয হয়েছে। তবে সতীনের তালাক চাইতে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছে,হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “কোন নারী যেন তার বোনের (অপর নারীর) অংশ নিজের পাত্রে উপুড় করে নেওয়ার জন্য তালাকের ফরমায়েশ না করে। (সুনানে তিরমিযী,হাদীস নং:১১৯০)
এখন আপনার জন্য করণীয় হল,স্বামী স্ত্রীর মাঝে থাকা মনোমালিন্য,ঝগড়া বিবাদ নিজেরাই মিটমাট করে নেওয়া। আর এর জন্য প্রয়োজনে স্বামীর কাছে থাকার চেষ্টা করা। নিজের ভালবাসা দিয়ে স্বামীকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করা। কেননা আল্লাহ তাআলা মহিলাদের মাঝে এমন যোগ্যতা দিয়েছেন যার দ্বারা সে তার স্বামীকে আপন করে নিতে পারে। সকল অবৈধ সম্পর্ক থেকে যেন স্বামী বিরত থাকে এজন্য আল্লাহ তাআলার কাছে বেশি বেশি দুআ করা। এরপরও যদি কোনোভাবে মিটমাট করে নেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে নিজের আস্থাভাজন কোন মুরব্বীর সাথে পরামর্শ করে স্বামীকে বুঝানোর চেষ্টা করা এবং তাদের মাধ্যমে বিষয়টির ফায়সালা করে নেওয়া।
الاحالة الشرعية على المطلوب
قوله تعالي في”سورة البقرة”(٢٣٠) فان طلقها فلا تحل له من بعد حتي تنكح زوجا غيره
أخرج الإمام البخاري(رح ) في “صحيحه”(5066) وقال الليث عن نافع كان ابن عمر رضي الله عنهما إذا سئل عمن طلق ثلاثا قال لو طلقت مرة أو مرتين فإن النبي ﷺ أمرني بهذا فإن طلقها ثلاثا حرمت حتي تنكح زوجا غيره
أخرج الإمام الترمذي رح في”سننه”(1/226،برقم-1190) عن أبي هريرة رض يبلغ به النبي ﷺ قال:لا تسأل المرأة طلاق اختها لتكفي ما في انائها
وفي”عمدة القارى”(20/233) ومذهب جماهير العلماء من التابعين و من بعدهم منهم الأوزاعي والنخعي و الثوري وأبوحنيفة وأصحابه ومالك وأصحابه والشافعي وأصحابه وأحمد وأصحابه واسحاق وأبو ثور وأبو عبيد وآخرون كثيرون على أن من طلاق إمرأته ثلاثا وقعن ولكنه يأثم. وقالوا من خالف فيه فهو شاذ مخالف لأهل السنة ‘ وإنما تعلق به أهل البدع ومن لا يلتفت إليه لشذوذه عن الجماعة التي لا يجوز عليهم التواطؤ على تحريف الكتاب و السنة
وفي”الهدايه”(٢/٣٩٩) ان كان الطلاق ثلاثا في الحرة اوثنتين في الأمة لم تحل له حتي تنكح زوجا غيره نكاحا صحيحا ويدخل بها ثم يطلقها او يموت عنها
وفي”الهداية”(2/358) وطلاق المكره واقع
وفي”البزازية”(10/101) له امرأة أو جارية فأراد أن يتزوج أخرى فقالت اقتل نفسي،له ان يأخذ ولا يمتنع لأنه مشروع، قال الله تعالى”لما تحرم ما أحل الله لك تبتغي مرضات ازواجك ج والله غفور الرحيم”
وفي”فتاوى قاسمية”(14/182) الجواب وباللہ التوفیق:ایک مسلمان مرد کے لئے شریعت اسلامیہ میں دو بیوی کرنے کی اجازت ہے اور اس میں کسی بھی بیوی کو دوسری بیوی کو طلاق دینے کا مطالبہ کا حق نہیں ہے- نیز اگر دونوں کو برابر کرکے رکھتا ہے اور کسی کے حق میں کمی زیادہ نہیں کرتا ہے،تو کسی بیوی کو اپنی طلاق کا مطالبہ بھی جائز نہیں ہے
وفي”كتاب النوازل”(9/89) حدیث شریف میں اسکی سخت ممانعت وارد ہے کہ کوئ عورت اپنی سوکن کے متعلق طلاق یا تفریق کا شوہر سے مطالبہ کرے.
وراجع أيضا في”التاتارخانية”(4/429) و”الدر المختار”(4/137) و”رد المحتار”(4/423) و”كتاب النوازل”(9/33)، انتهى والله أعلم بالصواب